ভারতের যশোদা হাসপাতাল একইসাথে সফলভাবে হার্ট-ফুসফুস ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে ইতিহাস গড়লো
[ স্বাস্থ্যবাংলা ডেস্ক ]
সম্প্রতি ভারতের হায়দ্রাবাদের যশোদা হাসপাতাল প্রথমবারের মতো সফলভাবে হার্ট-ফুসফুস একইসাথে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে ইতিহাস তৈরি করেছে। যদিও হায়দ্রাবাদের সিকান্দাবাদে যশোদা হাসপাতালের এমন সফলতা যে একেবারে নতুন তা নয়, যশোদা গ্রুপ অব হসপিটালের দীর্ঘ ৩০ বছরের ইতিহাসে হরহামেশায় অসংখ্য কিডনী, লিভার, হার্ট, ফুসফুস সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তবে প্রথমবারের মতো সফলভাবে একই ব্যক্তির একইসাথে হার্ট-ফুসফুস প্রতিস্থাপন যশোদা হাসপাতাল গ্রুপের সফলতার মুকুটে যে আরো একটি স্বর্ণালী পালক যোগ করলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর এই হার্ট-ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা হয় নিজামাবাদ জেলার দারপল্লী গ্রামের স্থানীয় সরকারি স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে অধ্যয়নরতা ১৩ বছরের বালিকা নিতিশার এবং এই হার্ট-ফুসফুস প্রতিস্থাপনে ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জনদের নেতৃত্ব দেন যশোদা হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিওথোরাসিক ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ডাঃ নরেশ কুমার।
জানা যায় যে, গত ৪ঠা জানুয়ারী স্কুলের প্রাতঃকালীন প্রার্থনা চলাকালীন সময়ে হটাত করেই নিতিশা মেঝেতে পড়ে যায় এবং অচেতন হয়ে পড়ে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনতিবিলম্বে নিতিশার অভিভাবককে জানান এবং মেয়েটির বাবা-মা ছুটে এসে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসক নিতিশাকে যশোদা হাসপাতাল সেকেন্দ্রাবাদে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। সেখানে নিতিশা প্রাথমিক পালমোনারি হাইপারটেনশন (পিপিএইচ) রোগে ভুগছে ধরা পড়ে যে কারণে তার হার্ট ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অতঃপর সার্বিক বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ নিতিশা’র জীবন বাঁচাতে কম্বাইন্ড হার্ট-লাং ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন অর্থাৎ একইসাথে হার্ট ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত দেন। কেননা নিতিশা’র এরকম অবস্থায় এছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার। অতঃপর জানুয়ারী’র তৃতীয় সপ্তাহে নিশিতার রাষ্ট্রীয় ‘জীবনদান স্কীম’এ রেজিস্ট্রিকরণ করা হয় এবং ডোনার বা অঙ্গদানকারী দাতা’র প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। ভাগ্যক্রমে হায়দ্রাবাদ গ্লোবাল হাসপাতালে ইন্ট্রাক্রেনিয়াল ফ্লুইড ব্লিডিং আক্রান্ত তিন সন্তানের জননী ২৭ বছর বয়স্কা একজন ব্রেইনডেড গৃহিণী’র পরিবারের সম্মতিতে ভদ্রমহিলার হার্ট ও ফুসফুস মিলে গেলো।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো এই নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবার কিভাবে এই বিশাল অংকের অর্থের সংকুলান করবেন, কেননা এধরণের অঙ্গ প্রতিস্থাপনে ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে থেমে থাকলো না কোনকিছু, নিতিশাকে অপারেশনের জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত রাখা হলো। যশোদা হাসপাতাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ জি এস রাও উদ্যোগী হয়ে যশোদা হাসপাতাল গ্রুপ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা এবং রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে ২৫ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করলেন, সেই সাথে নানা দূর্লভ ও অত্যন্ত মূল্যবান জীবনদানকারী ওষুধপত্র নামমাত্র মূল্যে নিশিতার চিকিৎসার্থে যশোদা হাসপাতাল থেকেই সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন। আজকাল কর্পোরেট হাসপাতালগুলো যেখানে উচ্চ চিকিৎসাখরচ আদায়ে রোগীদের গলা কাটতে দ্বিধা করছে না, সেখানে যশোদা হাসপাতালের এমন মানবিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এপ্রসঙ্গে নিতিশা’র বাবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সকল চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, “আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের মেয়ে এই হাসপাতালে চিকিত্সার সর্বোত্তম সুবিধা ও সেবা পেয়েছে। আমরা জানি এধরণের চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল অথচ বিশ্বমানের যে চিকিৎসা আমার মেয়ে পেয়েছে তার জন্য আমাদের একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি”।
দাতা মিলে যাবার খবর নিতিশা’র পরিবার কে জানানো হয়। স্থানীয় হাসপাতালে দাতার হার্ট ও ফুসফুস সংগ্রহ করা হয় এবং একটি সবুজ গণ্ডি তৈরি করে তার মধ্য দিয়ে সেগুলো যশোদা হাসপাতালে আনা হয়। এদিকে, ডাক্তারদের অন্য দল এই ঐতিহাসিক সম্মিলিত হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস প্রতিস্থাপন জন্য সবকিছু প্রস্তুত। দাতার হার্ট ও ফুসফুস সিকান্দ্রাবাদে যশোদা হাসপাতালে পৌঁছানোর সাথে সাথেই নিতিশার অপারেশন শুরু করা হয়। বিকেল ৩:৪৫ এ শুরু হয়ে দীর্ঘ আটঘন্টায় অর্থাৎ রাত ১১:০০ টায় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল অবস্থায় আইসিইউতে স্থানান্তরিত হয়। সেইসাথে যশোদা হাসপাতাল তথা তেলেঙ্গনা রাজ্যের চিকিৎসার ইতিহাসে ৯ই জুন ‘২০১৭ যোগ হলো একটি নতুন অধ্যায়ের। নিতিশাকে ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সার্জারির ২ সপ্তাহ পর আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। যশোদা হাসপাতাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ জি এস রাও বলেন, “হার্ট ফুসফুসের মতো যৌথ অঙ্গ প্রতিস্থাপন এটি একটি চ্যালেঞ্জ। অত্যন্ত অভিজ্ঞ সার্জন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, যশোদা হাসপাতালের অতি উন্নতমানের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটি, এগুলো আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার এবং এটি সম্পূর্ণভাবে সফল করার জন্য আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।”
এধরণের অস্ত্রোপচার বাস্তবিকই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপিত হার্ট বা ফুসফুস শরীর গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু এই সফল হার্ট-ফুসফুস প্রতিস্থাপনে নিশিতা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। নিতিশা’র বাবা তাঁর মেয়ের দ্বিতীয় জীবন প্রাপ্তিতে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানান।