বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সাম্প্রতিক সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য আলোচনার বিষয়। ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আমরা অধিকাংশই কোন না কোন সময়ে আক্রান্ত হয়েছি যা খুব সাধারণ একটা রোগ। পাখিদেরও এমন সাধারণ বার্ড ফ্লু কিভাবে মারাত্নক মানবঘাতি রোগে পরিণত হল এবং এই রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন
বার্ড ফ্লু কিঃ
এককথায় বলা যায় বার্ড ফ্লু হচ্ছে পাখিদের ফ্লু। ফ্লু ভাইরাসের অনেক ধরনের উপবিভাগ রয়েছে। এই সাবটাইপ বা স্ট্রেইনগুলো ঘন ঘন তাদের গঠনে পরিবর্তনের মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের ভাইরাসের উদ্ভব ঘটায়। এমনই এক ধরনের পাখিদের ফ্লু ভাইরাসকে বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ এ বলা হয়। এদের মধ্যে H5N1 সাব টাইপ ভাইরাসটাকেই মানুষের জন্য মারনঘাতী বলা হচ্ছে।
বার্ড ফ্লু কিভাবে ছড়ায়ঃ
বার্ড ফ্লুর ভাইরাস আক্রান্ত পাখির খাদ্যনালীতে/ অন্ত্রে বাস করে। পাখির মুখের লালা এবং মলের মাধ্যমে জীবাণু বাইরে বেরিয়ে আসে এবং বাতাসের বা পানির মাধ্যমে সেটি অন্য পাখিকে আক্রান্ত করে। একটি আক্রান্ত পাখি ১০ দিন পর্যন্ত জীবাণুর সংক্রমণ করতে পারে।
মানুষ কিভাবে আক্রান্ত হয়ঃ
এই ভাইরাস বাতাস, পানি বা সংক্রমিত বস্তু স্পর্শ করার মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে। আমাদের দেশে অতিথি পাখির মাধ্যমেও এটা ছড়াতে পারে।
কারা বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় আছেনঃ
- যারা খামারের হাঁস-মুরগীর সংস্পর্শে আসেন
- আক্রান্ত পাখিকে কেউ স্পর্শ করলে(আক্রান্ত পাখি জবাই বা পালক ছাড়ানোর জন্য ধরা)
- যারা আক্রান্ত পাখির মাংস বা ডিম কাঁচা অথবা অর্ধসিদ্ধ করে খান
- বার্ড ফ্লু আক্রান্ত স্থানে ভ্রমণকারী ও আক্রান্ত হতে পারেন
- আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকেন
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকর্মী
বার্ড ফ্লু রোগের উপসর্গ/লক্ষণ সমূহঃ
- জ্বর(১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে)
- কাশি
- শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
- মাথাব্যথা
- গলা ব্যথা
- নাক দিয়ে পানি পড়লে
- গায়ে ব্যথা
- পাতলা পায়খানা
বিপদজনক লক্ষণ সমূহঃ
- দ্রুত শ্বাস নেয়া(বিশ্রাম বা পরিশ্রম কালীন সময়ে)
- তীব্র শ্বাস কষ্ট
- শরীর নীলচে হয়ে যাওয়া
- বুকে ব্যথা
- কফের সাথে রক্ত যাওয়া
- রক্ত চাপ করে যাওয়া
- মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হওয়া
- ৩ দিনের বেশি উচ্চমাত্রায় জ্বর থাকা
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিপদজনক লক্ষণ সমূহঃ
- দ্রুত শ্বাস নেয়া বা শ্বাস কস্ট হওয়া
- অমনোযোগী হয়ে পড়া
- ঘুম থেকে সহজে জাগতে না পারা
- খেলাধুলার প্রতি অনীহা
রোগীর মৃত্যুর কারণ মূলত ভাইরাস জনিত নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাস কষ্ট এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে পড়া।
নিজে অসুস্থ হয়ে থাকলে করনীয়ঃ
-
ঘরে থাকুন ও কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ, জনসমাগম পরিহার করুন
-
বিশ্রাম নিন ও প্রচুর পানি পান করুন
-
হাচি-কাশির সময় রুমাল দিয়ে নাক মুখ ঢাকুন এবং টিস্যু বা রুমাল সাবধানে বর্জ্যে ফেলুন। এরপরে হাত সাবান বা অ্যালকোহল জাতীয় হ্যান্ডরাব দিয়ে ধুয়ে ফেলুন
-
হাতের কাছে টিস্যু না থাকলে হাতের কনুই এর সামনের অংশ দিয়ে যতটা পারা যায় নাক-মুখ ঢাকুন
-
অন্যদের সামনে সংক্রমণ প্রতিরোধে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরুন
-
পরিবার ও পরিচিতদের আপনার অসুস্থতার কথা জানান ও সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন
-
জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিনে ৩-৪ টা খেলেই যথেষ্ট তবে এসপিরিন জাতীয় ঔষধ পরিহার করুন
-
প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাথে দেখা করুন
বিপদজনক লক্ষণ দেখা দিলে কি করতে হবেঃ
-
সন্দেহজনক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি এবং আলাদা করে রাখতে হবে
-
রোগীকে রোগ শুরুর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টি ভাইরাল শুরু করতে হবে
-
সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমন রোধে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে
-
কোন কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্টেরয়েড দিতে হবে
-
লক্ষণ ভিত্তিক ও সহায়ক চিকিৎসা দিতে হবে
-
পানিস্বল্পতা পূরণ ও পুষ্টিকর খাদ্য দিতে হবে
ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে বাঁচার উপায়ঃ
-
আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নূন্যতম ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা
-
মুখ ও নাক স্পর্শ পরিহার করা
-
অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ পরিহার করা
-
জনসমাগম স্থলে বেশি সময় ব্যয় না করা
-
ঘরের মাঝে আলো বাতাস প্রবেশ করতে দেয়া
-
খালি হাতে অসু্স্থ্য বা অস্বাভাবিকভাবে মৃত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা-ছোঁয়া ও নাড়াচাড়া করা যাবে না
-
বাড়িতে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি জবাই করা বা পালক ছাড়ানো অথবা নাড়াচাড়া করা যাবে না
-
রোগে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা-ছোঁয়া ও সেগুলো নিয়ে খেলা ধুলা করা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হবে
-
হাঁস-মুরগি বা পশুপাখি ধরা-ছোঁয়ার পর ভাল করে সাবান এবং পানি দিয়ে দুই হাত পরিষ্কার করে ধুতে হবে
-
হাঁস-মুরগি বা পশুপাখি দেখাশোনা করার সময় কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নিতে হবে। পশুপাখি নাড়াচাড়ার পর সেই হাত না ধুয়ে চোখ,নাক বা মুখে লাগানো যাবে না
-
হাঁস-মুরগির মাংস ভালোভাবে রান্না করতে হবে। আধা সিদ্ধমাংস, ডিম বা মাংসের তৈরী খাবার খাওয়া যাবে না
-
বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছে এমন স্থানে বা তার আশে পাশে যারা বসবাস করে,তাদের জীবন্ত হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পাখি ক্রয়-বিক্রয় বা জবাই করার স্থানে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
-
রোগে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখির মল সার অথবা মাছের খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করা যাবে না
-
যদি কোথাও হঠাৎ হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি অস্বাভাবিকহারে মারা যায় তবে সাথে সাথে ওয়ার্ড কমিশনার অথবা উপজেলা পশু হাসপাতালে জানাতে হবে। মৃত হাঁস-মুরগি এবং পাখি মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে
-
হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা ছোঁয়ার পর যদি কেউ জ্বর-সর্দি-কাশি জাতীয় কোন রোগে ভোগেন তবে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে/হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে
-
রোগীকে হসপিটালে আলাদা করতে হবে
-
মাস্ক, গ্লাভস্, গাউন, চশমা পরে রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে
-
প্রতিবার রোগী দেখার পর হাত মুখ ভালো করে সাবান দিয়ে ধুঁতে হবে
-
যারা রোগীর সংস্পর্শে আসবে তাদেও মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নজর রাখতে হবে
-
স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীর চিকিৎসাকালে প্রতিরোধমূলক ওসেল্টামিভির (Oseltamivir) খেতে হবে
মাস্ক ব্যবহার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাঃ
-
অসুস্থ না হলে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই
-
অসুস্থ রোগীর সেবা বা সংস্পর্শের কাজে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহারের পরে টা নির্দিষ্ট বর্জ্যে ফেলতে হবে ও ভালোভাবে হাত পরিস্কার করতে হবে
-
অসুস্থ ব্যক্তি, ভ্রমনের সময় ও অন্যদের সংস্পর্শে এলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে
-
সঠিক নিয়মে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ভুল নিয়মে মাস্ক ব্যবহার করলে রোগ সংক্রমণ ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়
চিকিৎসার জন্য যোগাযোগ
-
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
-
জেলা সদর হাসপাতাল
-
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
-
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
-
বিশেষায়িত হাসপাতাল- আই ই ডি সি আর, মহাখালী
-
বেসরকারী বা এনজিও হাসপাতাল
পরিশেষে এটা বলা যায় বার্ড ফ্লু নিয়ে খুব আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। সঠিক নিয়ম মেনে চললে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া যাবে।
সোর্সঃ জাতীয় ই তথ্য কোষ
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন
www.ncbi.nlm.nih.gov
www.google.com