বন্ধুর পথে দুর্গম যাত্রা – ডাঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

বন্ধুর পথে দুর্গম যাত্রা – ডাঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন  [স্বাস্থ্য বাংলা ডেস্ক]

(এদেশের ক্যান্সার প্রতিরোধ সামাজিক সচেতনতা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বায়ক ডাঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন গাজীপুরে সমাজভিত্তিক ক্যান্সার সেন্টার প্রতিষ্ঠার  বিষয়ে তাঁর চিরাচরিত অনবদ্য লেখনীতে চিত্রিত করেছেন তাঁর স্বপ্নের কথা, বিশ্বাস – আস্থার কথা, মানুষের ভালোবাসার এক অনন্য গল্প গাঁথা)

গতকাল গাজীপুরে তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কথা বলেছি। বলেছি গাজীপুরে সমাজভিত্তিক ক্যান্সার সেন্টার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখার কথা। বিশাল অবকাঠামো আর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নয়, যার শুরু হবে সমাজভিত্তিক গণমুখি ছোট ছোট কর্মসূচী দিয়ে। প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যান্সার নির্নয় কেন্দ্র, বহির্বিভাগ, ডে-কেয়ার সেন্টার, দূর-দূরান্তের রোগীদের জন্য আশ্রয় ও পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে। পাশাপাশি চলবে জমি সংগ্রহ, অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তুতি। ধাপে ধাপে একটি আধুনিক সুসজ্জিত পূর্ণাংগ ক্যান্সার সেন্টারে রূপ দেয়ার ধৈর্যশীল প্রচেষ্টা।

তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।

প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটি হবে সম্পূর্ণ অলাভজনক, সবক্ষেত্রে ২৫% সেবা গরিব রোগীদের বিনামূল্যে প্রদানের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

কেউ যাতে এখানে বাণিজ্যিক মানসিকতার অনুপ্রবেশ ঘটাতে না পারে, তার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা।

এবং স্বচ্ছতা।

বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ক্যান্সার সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ‘ক্যান্সার সেবা’ দেয়ার জন্য কোনক্রমেই যথেষ্ট নয়। এই মূহুর্তে দেশে একটিও বিশেষায়িত ক্যান্সার সেন্টার নেই। আছে জেনারেল হাসপাতালের অনকোলজি ইউনিট। আর আছে ‘ক্যান্সার এন্ড জেনারেল’ হাসপাতাল। এরমধ্যে পথিকৃৎ ডেলটা অনকোলজি ইউনিট, আগে ধানমণ্ডিতে ছিল একটি জেনারেল ক্লিনিক হিসেবে। দেশের অন্যতম পথিকৃৎ হিস্টোপ্যাথলজিস্ট প্রফেসর এম মোকাররম আলী ও শীর্ষস্থানীয় অনকোলজিস্ট অধ্যাপক এম এন হুদা- দুই দিকপালের সম্মিলনে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখানে চিকিৎসার খরচ ছিল সহনীয় পর্যায়ে। সম্প্রতি কর্পোরেট কিছু হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হয়েছে, যেখানে বিত্তবান মানুষরা সেবা নিতে পারছেন। উচ্চ ব্যয়ের কারণে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দুইটি কেন্দ্র চালু হয়েছে রেডিওথেরাপি সুবিধা সহ। ক্যান্সার সোসাইটি ঢাকায়, এবং রোটারি ক্লাব রাজশাহীতে পূর্ণাংগ ক্যান্সার হাসপাতাল চালুর লক্ষ্যে কাজ শুরু করে সীমিত সেবা চালু করেছে।

আমি মনে করি, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে আবশ্যিক ৪টি উপাদান অর্থাৎ প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় নির্ণয় (স্ক্রিনিং), রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, এবং প্রশমন সেবা- সবগুলিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এবং চিকিৎসার বিভিন্ন শাখা নিয়ে সমন্বিত ক্যান্সার সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ভীষণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ধরণের একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেনি ।

সবচেয়ে কার্যকর পন্থা সরকারি খাতে জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে এ ধরণের সমন্বিত ক্যান্সার সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও সরকার বরাবরই ক্যান্সার চিকিৎসায় অর্থবরাদ্দে উদার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় সমান গুরুত্ব না পাওয়ার কারণে সমন্বিত ব্যবস্থা ও বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয় না। নীতি নির্ধারকদের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা ও জনমত গঠনে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন, এমন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও আঞ্চলিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি হাসপাতালের মত, কিংবা কাছাকাছি ব্যয়ে ক্যান্সার সেবা দিতে তারাই পারবেন ।

ক্যান্সার প্রতিরোধ কর্মী ও একজন রোটারিয়ান হিসেবে আমার চেষ্টা থাকবে, রোটারি ক্লাব ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিদের এই উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ করতে। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করতে রোটারির ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশে আজকের জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায় রোটারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এর প্রথম ভবনটি নির্মাণে ও ‘রোটারি ক্যান্সার ডিটেকশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠায়। বেশ কয়েকটি রোটারি ক্লাব ক্যান্সার সচেতনতায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে, যার অনেকগুলির সাথে আমার জড়িত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এ বছর রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১ গত ১০ অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস উদযাপনে যৌথ আয়োজক হিসেবে এই কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করেছে। আগামী ১৩ জানুয়ারি (প্রতি বছর জানুয়ারির ২য় শনিবার) জরায়ু- মুখের ক্যান্সার সচেতনতা দিবস উদযাপনে যৌথ আয়োজক হিসেবে আরেকটি মাইলফলক ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। রাজশাহী ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে উঠছে রোটারির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, যা আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র হিসেবে পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

আশা করছি আগামি দিনগুলোতে রোটারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণে গাজীপুরে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বিত সমাজভিত্তিক ক্যান্সার কেন্দ্র গড়ে তোলা ও রাজশাহীর মত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিক উদ্যোগ সফল হলে সরকার নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে।

এবার গতকালের সাফল্য ও অনুপ্রেরণার গল্প। সেই তিনটি সংগঠনের কাছেই পাওয়া গেছে সর্বাত্মক সহযোগিতার অঙ্গীকার, এটা আগেই উল্লেখ করেছি। তাৎক্ষণিক ভাবে দুইজন সাহসী মানুষের কথা আমাকে বিস্মিত করেছে। একজন দৃঢ়তার সাথে বললেন, এই উদ্যোগে তিনি ৫ লাখ টাকা আর শ্রীপুর এলাকায় জমি দিতে রাজী আছেন। দ্বিতীয়জন চমকে দিলেন ৫০ লাখ টাকা ও জমি দেওয়ার কথা বলে সমান দৃঢ়তার সাথে।

আরও বহু আগে, সৌদী আরব থেকে পরবাসী ভাই মাসুদ ওয়াদা করিয়ে রেখেছেন, এই উদ্যোগে প্রথম অনুদান হিসেবে তিনি তাঁর কষ্টার্জিত ৫০ হাজার দিতে চান।

আমি জানি, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ কাজ নয়। স্বতঃস্ফূর্ত ঘোষণা সব ক্ষেত্রে বাস্তবে পালন করা সম্ভব হয় না, নানা কারণে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজের ঘাড়ে একটি বড় দায়িত্ব নিয়েছি দেশজুড়ে ক্যান্সার সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার। একা এই কাজ করা সম্ভব নয় বলে বিভিন্ন এলাকা ও শ্রেনী-পেশার মানুষের মাঝে থেকে সহযোগী সংগঠন তৈরী করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আরও কিছু নিবেদিত সহযোদ্ধার বলে বলীয়ান হয়ে। হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজ আমার নয়। এর জন্য কিছু নিবেদিত যোগ্য ও নির্লোভ মানুষ খুঁজে পেতে হবে। দরকার হবে ভোগবাদী সমাজের মধ্য থেকেই কিছু মানবিক চিকিৎসক। আমি শুধু সূত্রধরের ভূমিকায় থাকতে চাই।

কাজটি দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আর সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা তো থাকতেই হবে। তাঁর প্রিয় সৃষ্টি- মানুষের জন্য যে এই উদ্যোগ। তিনি কি তা বৃথা হতে দিবেন?

Related posts

Leave a Comment