ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেন কথা বলেছেন স্বাস্থ্যবাংলার সাথে। একান্ত এই আলাপে উঠে এসেছে তার জীবন দর্শন ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের নানা কথা।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ শৈশব কোথায় কাটিয়েছেন?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। পুরানো ঢাকার বেচারাম দেউড়ির পাশেই ছিল আমাদের বাসা। আমার বাবা মরহুম আনোয়ার হোসেন, মা মরহুমা সৈয়দা মাকসুদা খাতুন। আমরা দুই ভাই, আমি ছোট। জন্মের পর থেকে একান্নবর্তী পরিবারে সবাই একসাথে বড় হয়েছি।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ লেখাপড়া কোথায় করেছেন?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ বাসার পাশেই আরমানিটোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৬১ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে। পড়াশুনা আর খেলাধুলার মাঝেই পার করেছি স্কুল জীবন। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই ১৯৬৯ সালে। ১৯৭২ সালে ভর্তি হই ঢাকা মেডিকেল কলেজে। স্বাধীনতার পরে আমরাই ছিলাম প্রথম ব্যাচ। আমি কে ৩০ এর ছাত্র। ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস এর পরে সার্জারিতে বিসিপিএস হতে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করি ১৯৮৫ সালে এবং আমেরিকা থেকে এফআইসিএস লাভ করি ১৯৯৩ সালে।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ মেডিকেল সাইন্সে পড়াশোনার পেছনে কার অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ আমার মা ছিলেন মূল প্রেরণা। মূলত তার ইচ্ছাতেই আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেই। আমার সবসময়ের প্রিয় বিষয় ছিল গণিত। গণিত ভালবাসতাম এবং এখনো ভালবাসি। ইচ্ছা ছিল গনিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার তবে অবশেষে আমি আমার মায়ের চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন কোন ঘটনা মনে পড়ে?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ অনেক ঘটনাই মনে পড়ে। মনে পড়ছে ১ম প্রফেশনাল পরীক্ষার সময় আমাদের আন্দোলনের ঘটনা। সেসময় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো ১ম প্রফেশনাল পরীক্ষা পেছানোর। আমরা তখন আন্দোলন করি পরীক্ষা যথাসময়ে দেয়ার জন্য এবং আমাদের আন্দোলন সফল হয়, আমরা সঠিক সময়েই পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম। আজকের দিনে সকলে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করে আর আমরা করেছিলাম পরীক্ষা না পেছানোর আন্দোলন।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ ডাক্তার হিসেবে সার্জারিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ কি ছিল?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ কলেজ জীবন থেকেই সার্জারির প্রতি একটি অন্যরকম ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছিলো। ৩য় বর্ষে থাকাকালীন প্রথম সার্জারি ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট হয় আমাদের। আমাদের সার্জারির তৎকালীন প্রফেসর ডাঃ এ টি সিদ্দিক ও রেজিস্ট্রার ডাঃ সেলিম ভূঁইয়া স্যারের আন্তরিক শিক্ষাদান ও সার্জারি বিষয়ের প্রতি তাদের আন্তরিক ভালবাসা আমাকে করে ছিল সার্জারির প্রতি উৎসাহী। আরো ভাল লাগতো এটা দেখে যে, একজন সার্জন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সকল কষ্ট দূর করে দিতে পারেন একটি মাত্র অপারেশন করে। বহুদিনের ভুক্তভোগী রোগীর অপারেশন শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফেরার দৃশ্য আমাকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। তখন থেকেই আমি নিজেকে একজন সার্জন হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করি।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ আপনার নিজস্ব বেশ কিছু রীতিনীতি আপনি আপনার ওয়ার্ডে মেনে চলেন। এসব রীতি ও পদ্ধতি অনুসরনের মূল উদ্দেশ্য বা কারণ কি?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ ডাক্তারি জীবনের প্রথম থেকেই আমি সময় মেনে কাজ করেছি। আমার ওয়ার্ডে আমি সহ সকল ডাক্তারকে সকাল ৭ থেকে দুপুর ২.৩০ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকতে হয়। ওয়ার্ডের কজ সঠিকভাবে করতে এটা অনেক সাহায্য করে। সময়ানুবর্তীতার এ শিক্ষা পেয়েছি আমার পরিবার ও প্রিয় শিক্ষকদের কাছ থেকে। আমি সবসময় নিজের হাতে ধরে আমার অধিন্যস্ত ডাক্তারদেরকে অপারেশন শেখাই। ৩০ মিনিটের একটা অপারেশন শেখাতে গিয়ে ১ থেকে ২ ঘণ্টায় শেষ করি। আমরা যদি এদেরকে না শেখাই তবে শেখাবে কে? শেখানোর এ দায়িত্ব আমার নিজের। আমি চাই আমার জুনিয়র ডাক্তারের হাত যেন আমার থেকে ভালো হয়। এ দায়িত্বের কথা আমার মা আমাকে সবসময় স্মরণ করিয়ে দিতেন। বাসায় ফিরলে জানতে চাইতেন ওইদিন জুনিয়রদেরকে কি শিখিয়েছি। ওয়ার্ডে যেসব পদ্ধতি আমি ও আমার ডাক্তাররা মেনে চলে সেগুলো আমাদের রোগীদের জন্যই আমরা মেনে চলি। একজন রোগীকে সঠিকভাবে সর্বোচ্চমানের চিকিৎসা দেয়ার ভাবনা থেকেই আমরা নিয়মগুলো পালন করি।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ বর্তমানে অনেকেই ডাক্তারদের সততা, তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আপনি এ ব্যাপারে কি বলবেন?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ একটা কথা বলতে পারি, সততা রক্ষা করতে পারলে একজন ডাক্তারের থেকে সৎ আর কেউ হতে পারবে না। আমাদের দেশের সার্বিক অবক্ষয়ের কারণে কিছু ডাক্তারের নৈতিক অবনতি হয়েছে ঠিক তবে তাই বলে গোটা ডাক্তার সমাজ অসৎ নয়।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ আগের চেয়ে এখন সার্জারির উৎকর্ষতা কতখানি এগিয়েছে বলে মনে করেন? অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ অগ্রগতি হয়েছে অসাধারণ। এখন ঢাকা মেডিকেলে অনেক অপারেশন হচ্ছে যা আগে হতো না, এমন অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে যা আগে ছিল কেবল স্বপ্ন। ঢাকা মেডিকেলে এখন থোরাসিক সার্জারি, নিউরোসার্জারি, ইউরোলজি, অর্থোপেডিক্স, অপথালমোলজি, ইএনটি ইত্যাদি বিভাগ খোলা হয়েছে। এক ছাদের নিচে এমন নানা রকম রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা বিশ্বে খুব কমই আছে।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ ভবিষ্যতে অবশ্যই করতে চান নিজের এমন কোন স্বপ্নের কথা বলুন
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ আমার সারাজীবনের ইচ্ছা সার্জারি বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ বই লেখা কিন্তু সময়ের অভাবে সেকাজে হাত দেয়া হচ্ছে না যদিও ইতিমধ্যে পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ অনেকটা এগিয়েছে।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ নিজের পেশাগত জীবনে ঘটা কোন স্মরণীয় ঘটনার কথা জানতে চাই
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ ১৯৮৭ সালের দিকে একজন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন হসপিটালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্নক আহত হয়ে। সবাই তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেও আমি তার অপারেশন করি এবং আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেন। এই ঘটনা বার বার মনে পড়ে।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ মেডিকেল শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন ডাক্তার এবং নবীন সার্জনদের জন্য কি উপদেশ থাকবে?
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কে বলবো সবসময় মূল পাঠ্যপুস্তক এবং স্বীকৃত লেখকের বই পড়তে। ইন্টার্ন ডাক্তারদের উদ্দেশে বলবো সবসময় সৎ থাকার কথা। নতুন সার্জনদের কে বলবো নিজের সিনিয়র স্যারদের কাছ থেকে বেশি করে কাজ শিখে নিতে। সকল অভিজ্ঞ সার্জন যদি তাদের অধিনস্ত ডাক্তারদের নিজ হাতে শেখাতেন তবে এদের দক্ষতা অনেক বৃদ্ধি পেত।
স্বাস্থ্য বাংলাঃ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
অধ্যাপক মোঃ শহীদ হোসেনঃ স্বাস্থ্যবাংলাকেও অনেক ধন্যবাদ
কিছু অজানা তথ্যঃ
আদর্শঃ মহানবী হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)
প্রিয় লেখক/কবি/গীতিকারঃ কাজী নজরুল ইসলাম
প্রিয় রঙঃ সবুজ
প্রিয় পোশাকঃ সাফারি
প্রিয় খেলাঃ হকি, ক্রিকেট
প্রিয় খাবারঃ খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি
অবসরে ভালবাসিঃ গল্পের বই পড়তে, মাসুদ রানা সিরিজের ভক্ত
প্রিয় বইঃ Dorland’s Illustrated Medical Dictionary
পরিবারঃ স্ত্রী ও তিন পুত্র সন্তান
সাক্ষাৎকার নিয়েছেনঃ ডাঃ রায়হান কবীর খান
সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে ২৫/০৩/২০১২
দীর্ঘদিন যাবত আমার বাম হাতের ব্লেডের মাথায় জ্বালাপোড়া করছে। এই জ্বালাপোড়া আস্তে আস্তে ছোট থেকে ভড় হচ্ছে। এইক্ষেত্রে আমি কি করব বুঝতে পারছি না।