প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে

টাইফয়েড রোগের চিকিৎসায় প্রচলিত বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে গেছে, কোনো কোনোটি কার্যকারিতা হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।


বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা বলেছেন, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক মানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করায় টাইফয়েড ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হয় না। ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠায় টাইফয়েডের চিকিৎসা ব্যয় ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।


আইসিডিডিআর,বি ২০০৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার কমলাপুর স্টেশন ও এর আশপাশের এলাকার টাইফয়েডে আক্রান্ত মানুষের ওপর গবেষণা চালায়। গবেষণার আওতায় আসা রোগীদের গড় বয়স ৩২ দশমিক ৯ মাস। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রোগীর প্রায় ৫১ শতাংশের ক্ষেত্রে তিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক— বিটাল্যাকটাম, ক্লোরামফেনিকল ও কোট্রাইমোক্সাজল কার্যকারিতা পুরোপুরি হারিয়েছে। ৪৯ শতাংশের ক্ষেত্রে চার ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক—বিটাল্যাকটাম, ক্লোরামফেনিকল, কোট্রাইমোক্সাজল ও ন্যালিডিক্সিক এসিড কাজ করছে না। এ ছাড়া সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৪ শতাংশের দেহে কাজ করছে না বললেই চলে, ৮৮ শতাংশের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা ছিল মাঝারি ধরনের।

 


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। প্রতি বছর এ রোগে মারা যায় দুই লাখ মানুষ। তবে বাংলাদেশে প্রতিবছর কত মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, তার সঠিক হিসাব নেই।


বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেজবাহউদদীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে আগে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক ও স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে টাইফয়েড দেখা যেত। এখন এক বছরের কম বয়সী শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। দূষিত খাবার ও পানি, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও শৌচাগার, হাত ধোয়ার অভ্যাস না থাকা প্রভৃতি কারণে অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, সময়মতো টাইফয়েড ধরা না পড়লে এবং চিকিৎসা শুরু না হলে রোগীর নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি রোগীর পেটের ভেতর রক্তক্ষরণ ও ছিদ্র হয়ে যেতে পারে।
আইসিডিডিআর,বির চিকিৎসকেরা গবেষণায় দেখেছেন, মাল্টিড্রাগ রেজিসট্যান্ট টাইফয়েডে (এমডিআর টাইফয়েড—একাধিক ওষুধ যেসব রোগীর দেহে কাজ করছে না) আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার বেড়ে ৪ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।


আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানীরা বলেছেন, দেশে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রচুর। তবে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এক বছরের কম বয়সী শিশুরা। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকা থাকলেও শিশুদের জন্য টিকা নেই। এ কারণে বিজ্ঞানীরা ওষুধের যুক্তিসংগত ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যত দিন অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত নিত্যনতুন সমস্যা দেখা দিতে থাকবে।


আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফিরদৌসী কাদরী বলেন, ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠায় টাইফয়েডের চিকিৎসা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। সেফট্রিএক্সন ধরনের ইনজেকশন ও মুখে খাওয়ার সেফিক্সিম ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া এ রোগের চিকিৎসায় আর বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশে যে কেউ যেকোনো ওষুধ কিনতে পারেন। তাই এ দুটিও যে কত দিন কার্যকর থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই।


আইসিডিডিআর,বি বলেছে, আগে টাইফয়েড রোগটির চিকিৎসায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হতো। এখন খরচ হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি অনুষদের ডিন আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই অজ্ঞতা বা অসতর্কতাবশত অ্যান্টিবায়োটিক যে মাত্রায় যত দিন খাওয়া উচিত, তত দিন খান না। একটু সুস্থ বোধ করলেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। এতে জীবাণুগুলো সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায় এবং পরে আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন আর একই অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সহজে সারে না। এ ছাড়া নিম্নমানের ওষুধের মোড়কে যে মাত্রা লেখা থাকছে, বাস্তবে থাকছে তার চেয়ে কম। ফলে রোগী নিয়ম করে ওষুধ খেলেও লাভ হয় না।

 

 

Related posts

Leave a Comment