নবজাতক শিশু, দেখতে নাদুসনুদুস কিন্তু শুধু ঘুমায়। খেতে গেলেও ঘুমিয়ে পড়ে। কান্নার আওয়াজ ভাঙা ভাঙা। পাঁচ দিনেও একবার পায়খানা করে না। কেমন সন্দেহ লাগে সবার মনে। চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলে তিনি পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছুই খুঁজে পান না। কিন্তু দুই সপ্তাহ পরও যখন জন্ডিস সারে না, তখন নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। তিনি চোখ দেখেন, মুখ দেখেন, জিহ্বা দেখেন। ওজন দেখেন। মাপজোঁক দেখেন। শেষে পরীক্ষা করতে দেন রক্ত। অতিশব্দ পরীক্ষা।
পরীক্ষার ফলাফল দেখে বলেন, হরমোনের অভাব। শরীরে এক অতিপ্রয়োজনীয় প্রাণরস তৈরি হচ্ছে না। তাই শিশুর বিকাশ হচ্ছে অস্বাভাবিক। এখন বোঝা না গেলেও কিছুদিন পর দেখা যাবে, তার সারা শরীর মোটা থলথলে হয়ে গেছে। বসতে পারছে না ঠিক সময়ে। হাঁটতে পারছে না। সর্বোপরি বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে একদম ভোঁতা। চিন্তার ভাঁজ পড়ে মা-বাবাসহ সবার কপালে। থাইরয়েড হরমোনের অভাব। এমন অদ্ভুত সমস্যার কথা আগে তাঁরা কেউ শোনেননি। এখন উপায়? ডাক্তার অভয় দেন, এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি। বাইরে থেকে এ হরমোন যথাযথ মাত্রায় শরীরে দিলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শুরু হলো চিকিৎসা। দুই সপ্তাহের মধ্যেই হাসিখুশি হয়ে উঠল শিশু। নড়াচড়া বেড়ে গেল। কান্নার আওয়াজ শোনা যায় বাইরে থেকে। হন্যে হয়ে ওঠে খাবারের জন্য। পাঁচ মাসেই ঠেস দিয়ে বসতে পারে। পাথর নেমে যায় সবার বুক থেকে।
ওপরের দৃশ্যকল্পটি একটি বাস্তব ঘটনা থেকে নেওয়া। কিন্তু সব সময় কি এমন মধুর হয় পরিণতি? অনেক সময় বছরের পর বছর চলে যায় এ রোগ ধরা পড়তে। এ জন্য উন্নত বিশ্বে নবজাতকের থাইরয়েড হরমোনের (থাইরোক্সিন) মাত্রা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় দক্ষ চিকিৎসকের চোখও এড়িয়ে যেতে পারে শারীরিক সমস্যার লক্ষণগুলো।
কী হয়
গলার কণ্ঠার হাড়ের নিচে রয়েছে প্রজাপতির মতো একটি নালিহীন গ্রন্থি। সরাসরি এ থেকে উৎসারিত থাইরয়েড হরমোন এসে মেশে রক্তে। শরীরের বৃদ্ধি ও বিপাকক্রিয়ার এক প্রধান নিয়ন্ত্রক এ হরমোন। জন্মগতভাবেই এ হরমোন শরীরে অনুপস্থিত বা ভয়াবহ মাত্রায় কম থাকতে পারে।
কেন এ সমস্যা
থাইরয়েড গ্রন্থি যথাযথভাবে বিকশিত না হওয়ার কারণে হতে পারে এ সমস্যা। গ্রন্থির আকার ঠিক থাকলেও থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষণের কোনো পর্যায়ে থাকতে পারে এটি।
এ ছাড়া নবজাতকের মা থাইরয়েড হরমোন হ্রাসের চিকিৎসা নিয়ে থাকলে, খাবারে আয়োডিনের অভাব হলে, পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা থাকলে এবং হাইপোথ্যালমাসের সমস্যা থাকলে এটি হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থি বিকশিত না হওয়ার কারণ হিসেবে বংশগত একটি ভিত্তিও রয়েছে।
কী দেখতে হবে
দেখতে হবে শিশুর জন্মের পরপর মায়ের গর্ভাবস্থা প্রলম্বিত হয়েছে কি না। নবজাতক আকারে বড় কি না। মাথার হাড়ের মাঝের নরম পর্দা আকারে বড় কি না।
জন্মের পরপর শ্বাসকষ্ট আছে কি না। এ ছাড়া দুই সপ্তাহ পর শিশুর মধ্যে নরম থলথলে ভাব হবে, শিশু নির্জীব হয়ে উঠবে, দুর্বল ভাব, শরীরের তাপমাত্রা কম হবে, দুধপানে সমস্যা হবে।
বিলম্বিত লক্ষণ হিসেবে চোখের পাতা ফোলা, অমসৃণ চুল, শরীর ফোলা কান্নার ভাঙা আওয়াজ, দীর্ঘ মেয়াদের পর কানে না শোনা ও কথা না বলার সমস্যাও দেখা যেতে পারে।
কী পরীক্ষা করতে হবে
ফিল্টার পেপার স্পট পদ্ধতিতে থাইরয়েড হরমোন ও এর নিয়ন্ত্রক হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায়। জন্মের অন্তত ৪৮ ঘণ্টা পর পরীক্ষাটি করতে হবে। এর আগে করলে ভুল ফলাফলের ঝুঁকি থাকে। ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেলে সিরামের থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা এবং থাইরয়েড স্ক্যান করে দেখতে হবে। প্রত্যন্ত এলাকায় প্রাথমিক পরীক্ষা হিসেবে হাঁটুর হাড়ের এক্সরে করে অস্থির বিকাশে কোনো অপূর্ণতা আছে কি না তা দেখা যেতে পারে।
কেমন হবে চিকিৎসা-ব্যবস্থাপনা
একবার রোগ ধরা পড়লে সারা জীবনই রোগীকে থাইরয়েড হরমোন ট্যাবলেট খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবন রোগীকে প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহায়তা করবে।
ওষুধ সেবনের পর কোনো কোনো রোগী উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাতেও সাফল্য অর্জন করেছে। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় করা যায়, ততই সাফল্য আশা করা যায়। তবে দেরি হয়ে গেলেও কেউ হতাশ হবেন না। পাঁচ বছর বয়সে রোগ নির্ণীত হওয়ার পরও কোনো রোগী প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসতে পারে।