লিভার সিরোসিস ক্যানসার নয়

লিভার সিরোসিস, আঁতকে ওঠার মতো একটি রোগের নাম। সিরোসিস শুনলেই যেন মনে আসে, এটি আরও ভয়াবহ রোগের নাম, ‘লিভার ক্যানসার’। সিরোসিস আর ক্যানসার সাধারণ মানুষের কাছে একটি অন্যটির সমার্থক। অথচ ব্যাপারটি কিন্তু ঠিক তা নয়।

সিরোসিস কী?
সিরোসিস লিভারের একটি ক্রনিক রোগ, যাতে লিভারের সাধারণ আর্কিটেকচার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে লিভার হারায় তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা। অনেক ক্ষেত্রেই লিভার সিরোসিস থেকে লিভারে ক্যানসারও দেখা দিতে পারে। তবে এসব কোনো কিছুই হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোকের মতো সহসা ঘটে না। সিরোসিসে আক্রান্ত রোগী বহু বছর পর্যন্ত কোনো রকম রোগের লক্ষণ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম—ধরা যাক, আমাদের লিভারটা একটা আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, যাতে সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাই বিদ্যমান। এই অ্যাপার্টমেন্টের একটি কল নষ্ট থাকতে পারে কিংবা নষ্ট থাকতে পারে পুরো পানির সাপ্লাই লাইন অথবা আরও বেশি কিছু। ঠিক একইভাবে সিরোসিসেও লিভারে সামান্য কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিংবা সমস্যাটি হতে পারে অনেক বড় কিছু।
একটা পানির কল নষ্ট হলে যেমন অ্যাপার্টমেন্টের অধিবাসীদের কোনো সমস্যা হয় না, তেমনি কম্পেনসেটেড বা আর্লি সিরোসিসেও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কোনো অসুবিধা হয় না বললেই চলে। রোগের লক্ষণ আর কষ্টগুলো দেখা দেয় ডিকম্পেনসেটেড বা অ্যাডভান্সড সিরোসিসে, যখন ওই অ্যাপার্টমেন্টটির নষ্ট পানি সরবরাহ লাইনটির মতো লিভারেও বড় ধরনের গোলযোগ দেখা দেয়।

সিরোসিসের লক্ষণ কী?
আগেই যেমনটি বলেছি, কম্পেনসেটেড সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। অনেক সময় রোগী দুর্বলতা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, দাঁতের মাঢ়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া, পেটের ডান পাশে ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব, ঘনঘন পেট খারাপ হওয়া ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করতে পারে।
অ্যাডভান্সড সিরোসিসে চিত্রটি কিন্তু একদম বদলে যায়। এ সময় পায়ে-পেটে পানি আসে, জন্ডিস হয় এবং রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। রক্তবমি ও পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ফুসফুসে পানি আসা, কিডনি ফেইলিউর, শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে আনকন্ট্রোলড ব্লিডিং ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। আর সবচেয়ে যা ভয়াবহ, তা হলো লিভারে দেখা দিতে পারে ক্যানসার।

সিরোসিস কেন হয়?
এ তালিকাটি অনেক বড় এবং দেশভেদে সিরোসিসের কারণগুলোও বিভিন্ন। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিরোসিসের প্রধান কারণ অ্যালকোহল আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার রোগীর ওপর জরিপ চালিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, এ দেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, আর এর ঠিক পরেই রয়েছে ফ্যাটি লিভার। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও অ্যালকোহলের স্থান বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের অনেক পরে। ফ্যাটি লিভার নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া (রক্তে চর্বি বেশি থাকা), ওবেসিটি (মেদ-ভুঁড়ি), উচ্চরক্তচাপ আর হাইপোথাইরয়েডিজম ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণ। পাশ্চাত্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। এ দেশেও আমরা ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের রোগী পেয়ে থাকি। অতএব সাবধান।

সিরোসিস হলে কী করবেন?
সিরোসিসে আক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তির উচিত, দ্রুত লিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে চিকিত্সা নেওয়া ও নিয়মিত ফলোআপে থাকা। এতে দীর্ঘদিন ভালো থাকা যায়। পাশাপাশি সিরোসিসের কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা গেলে লিভারের খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। লিভার সিরোসিস ও এর কারণগুলোর আধুনিকতম চিকিৎসা আজ এ দেশেই সম্ভব। দেশে তৈরি হচ্ছে অধিকাংশ ওষুধও।
এ দেশে যা নেই, তা হলো লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের ব্যবস্থা। প্রতিবেশী দু-একটি দেশে এ সুযোগ থাকলেও তা খুব ব্যয়বহুল আর সংগত কারণেই আমাদের সিংহ ভাগ রোগীর সাধ্যের অতীত। তবে আশার কথা, এ দেশে রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ও হেপাটোলজিস্ট আর উদ্যমী বেসরকারি হাসপাতাল। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ল্যাবএইড স্পেশালাইড হাসপাতালেই অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে এ দেশের প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন সম্ভব হবে।

শেষ কথা
রাজনীতির মতো লিভার সিরোসিসেও শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায়ে সিরোসিসের রোগীকে শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যেহেতু আর্লি সিরোসিসে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে, তাই রোগী আর চিকিৎসক উভয়ের সচেতনতাটা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।

Related posts

Leave a Comment