মেডিকেল কলেজে র্যাগিং
[ডাঃ সুজয় দাসগুপ্ত]
(কোল্গকাতার প্রথিতযশা গাইনোকোলজিস্ট ও ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুজয় দাসগুপ্ত’র চিরায়ত অনবদ্য লেখনীতে মেডিকেল কলেজে র্যাগিং বিষয়ে এক চিত্তাকর্ষক স্মৃতিচারণ)
তখন সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছি। কিভাবে জানিনা ডাক্তারিতে ঢুকব বলে ঠিক করলাম (অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই)। প্রথম দিন খবর নিতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন পার্টির দাদারা (এটা পরে জেনেছি) ঘিরে ধরল, আর নিজে থেকে তাদের ফোন নম্বর ইত্যাদি দিতে শুরু করল (কারণটা পরে বুঝেছি)। ভর্তির দিন দেখলাম বিভিন্ন দাদারা “অযাচিত” ভাবে এগিয়ে এলে, কিভাবে ফরম ফিল আপ করব, কোথায় লিনে দেব, কি কি বই কেন উচিত ইত্যাদি। তারপর শুনলাম ৬ই আগস্ট ২০০৪ ফ্রেশারসহবে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর বন্ধুরা বলেছিল দিন নাকি র্যাগিং হয়। খুব ভয়ে ছিলাম। একমাত্র পৃথ্বীজিত দাকে খুব ভাল করে চিনতাম। মোটামুটি ফোনে যা বলেছিল, তার মর্মার্থ ছিল, ডে স্কলার’রা (যারা হোস্টেলে থাকেনা) সবাই সিপি(ছাত্র পরিষদ) করে। মোটামুটি ছাত্র লরিষদ করার সুবিধা, অসুবিধা, প্রয়োজনীয়তা, অপ্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি জেনে মুখস্ত করে নিয়েছিলাম। শেষে বললাম, কাল ফ্রেশার’সএ কি র্যাগিং করবে? হেসে বলল, “উল্টে দেখবি খুব খাতির করবে”। তারপর সত্যি দেখলাম সবার এত “অযাচিত” সাহায্য করতে আসা, নিজেকে সেলেব্রিটি মনে হচ্ছিল।
পরে বুঝেছি, আসলে এসব কে কলেজের পরিভাষায় “ছেলে তোলা” বলত।সিপি, ডিএসএ, এসএফআই সবাই চেষ্টা করে, দল ভারী করতে, যাতে ভোটটা ওরাই পায়। বুঝেছি দাদারা কেন অযাচিত সাহায্য করতে এগিয়ে আসত।
ইঞ্জিনিয়ারিং এর বন্ধুরা যখন র্যাগিং এর গল্প করত, ওদের জন্য খুব মায়া হত, আর আমি কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িনি (অবশ্য অংকে বরাবরই দিগগজ ছিলাম)সেই নিয়ে একটা শ্লাঘা অনুভব করতাম।
তারপর দেখেছি সেই সিনিয়রদের, কোনদিন তাদের কাছে গেলে মনে হয়নি যে “এই রে বোধহয় র্যাগিং করবে বলে ডাকছে”। ফ্রী উপদেশ শুনেছি যে এনাটমি ডিসেকশন ক্লাসে কি কি জিনিস শিখতে হয়, শিখেছি ফিজিওলজিতে তে একটু ফাঁকিবাজি করলেও চলে, শুনেছি বায়ো কেমিস্ট্রি ভাইভাতে তারা কিভাবে চাট খেত। আর তাদের সাথে বোধহয় পৃথিবীর এমন কোন জিনিস ছিলনা, আলোচনা করিনি। আর এই উপদেশের বন্যা কিন্তু মেট্রোতে যাতায়াতের পথেও কম শুনতাম না।
হ্যাঁ র্যাগিং হত, সেটা কিরকম বলি, হঠাৎ করে প্রশ্ন, এই মাসলকে কোন নার্ভ সাপ্লাইকরে, ওই আর্টারী’র ব্রাঞ্চ গুলো বল। যথারীতি বলতে না পারলে শুনতাম “এইভাবে পড়লে পাস করতে পারবিনা।”
হ্যাঁ আরো একটা ঘটনাকে র্যাগিং বলা যায়, বিসি রায় এর ছাদে ছাত্র পরিষদের মিটিং এ যেতে বলা হত, আর সেখানে দু একজন নেতা গোছের দাদা বলে যেত, কিভাবে ভোট দিতে হবে। আর সেই মিটিং এ যেন অবশ্যই যাই, সেই নিয়ে বারবার বলা হত, “আজ কিন্তু আসিস, এই মিটিং টা খুব দরকারসিপ।
আমি যেসব বন্ধুদের পাল্লায় পড়েছিলাম তাদের সবাই ছিল আমার মত ফাঁকিবাজ। সবারই মনে হল এত কিছু পড়তে পারব না, তাই প্রতি শুক্রবার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে যেতে হবে। কি কি সিনেমা দেখেছি, সেসব এখানে বলা যাবেনা। তখন আবার শুনতাম “এভাবে সময় নষ্ট করিসনা”। তারপর যখন সেমিস্টারএ ফেল করব মোটামুটি নিশ্চিত, তখন এই দাদারাই বাতলে দিত, “সহজে পাস করার পদ্ধতি”, কোনটা পড়ব, আর কোনটা পড়ব না। প্রথম সেমিস্টার নমনম করে দেওয়ার পরে এদের থেকেই জ্ঞান শুনতাম “এবার ভাল করে পড়, আর ও কয়েকটা মাস আছে, ঠিক উতরে যাবি”।
সেমিস্টারে যখন দেখলাম কোন অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে সবাই পাস করে গেলাম, তখন ও সেই এক ই জ্ঞান। হ্যা, এটাও হয়ত র্যাগিং।
হঠাৎ করে কিভাবে জানিনা সবাইকে অবাক করে বায়োকেমিস্ট্রিতে হায়েস্ট পেয়ে গেলাম। আমার জয়েন্টে রাঙ্ক ছিল ৮৮ (অস্টাশি), মেডিক্যাল কলেজে যারা চান্স পেয়েছিল তাদের মধ্যে একদম শেষের দিকে। এই ৮৮ থেকে ১ এ আসা নিয়ে যখন নিজেকে “আমি কি হয়ে গেলাম” ভাবতে শুরু করেছি, তখন ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট যে দাদা ছিল, তার বাণী “এই টুকুতে আটকে থাকলে হবেনা। এটা সেমিস্টার মাত্র, গোল্ড মেডেল পর্যন্ত যেতে হবে। এটাকে খুব বেশি কিছু ভাবিস না”। সত্যি ঈশ্বর আমাকে সেইটুকুতে আটকে রাখেননি, কিন্তু সেদিনের ওই কথাটা কানে কানে কেউ না বলে দিলে হয়তো পেছন ফিরেই তাকিয়ে দিন কাটত।
আরো র্যাগিংহয়েছে। লাইব্রেরিতে যখন যাঁরা বই নিয়ে বসতাম, আর সেই বই আর খোলা হতনা, ঘন্টার পর ঘন্টা ভাট বকে সময় কেটে যেত। যারা আমাকে চেনে, তারা জানে, আমি চুপ করে থাকতে পারিনা, আর গলার ভলিউমে টা নিয়ে কি আর বলব। তখন পাশের কিউবিক্যাল থেকে কোন দাদা বা দিদির বলে ওঠা, “এই আসতে কথা বল, নাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে কথা বল”। আর যারা এই ভাবে “র্যাগিং” করতে পারতনা, তাদের স্বগতোক্তি “উফফ এই গ্রুপটা আবার লাইব্রেরি তে ঢুকেছে, কাউকে পড়তে দেবেনা”। পরবর্তী কালে বেশ কিছু জুনিওর ও এই দ্বিতীয় উপায়ে আমাদের “র্যাগিং” করে গেছে।
আরো একটা র্যাগিংএর স্বীকার হয়েছি। “মেডিকেল কলেজের নামে একটা হুঊঊঊঊঊ” এই কথাটা কেউ বললে “হুঊঊঊঊ” কথাটা ৩ বার বাধ্যতামূলক ভাবে বলতেই হত। এটার কোনো ছাড় ছিলনা।
তারপর কোনোভাবে ফার্স্ট এমবিপাস করে ওয়ার্ড এ যাওয়া শুরু হল। তখন এই দাদা দিদিদের থেকেই শুনেছি কোনটা ভাল করে করতে হবে, আর কোনটাতে ফাঁকি মারতে হবে ইত্যাদি। বলা বাহুল্য ততদিনে নতুন ব্যাচ এসে গেছে। তখন না রইল আমাদের সেলেব্রিটি স্ট্যাটাস, না পেলাম র্যাগিং করার ক্ষমতা।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ভোট, পার্টি, পলিটিক্স এসব নিয়ে প্রচুর দলাদলি ছিল। কিন্তু পরীক্ষার হলে উত্তর না জানলে কারো খাতা দেখার সময় কেউ ভাবেনি “এই মালটা তো অন্য পার্টি করে”। মাইক্রোবায়োলজিতে জেডএন স্টেইনে ব্যাক্টেরিয়া না এলে পাশের জনের থেকে চুপচাপ স্লাইড নেওয়ার সময় কেউ ভাবেনি, “এ তো আমাকে ভোট দেয়নি”। ভাইভা তে “পাষন্ড” এগজামিনার কি প্রশ্ন করল আর তার কি উত্তর হবে, জানানোর সময় কেউ ভাবেনি, “মালটা আমাদের হেব্বি কেলিয়েছিল” (ক্যালক্যালি কিন্তু অন্তত একটা বার্ষিক উৎসব ধরনের ছিল)। থীয়রী লেখার সময় যে যেটা ভালো জানে, তাকে সেটা বলতেই হবে, আর আশেপাশের ৪-৫ জনের (যারা উত্তর টা জানত না) তাদের জন্মগত অধিকার ছিল শুনে শুনে উত্তর লেখা। তখনও কিন্তু ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লোকে নিজেদের ইনজুরির কথা বেমালুম ভুলে যেত।
যেসব দাদারা পিজিটি হয়ে ফিরে এসেছিল আর পরীক্ষা কন্ডাক্ট করত, তাদের ও মনে রাখতে দেখিনি কে কোন পার্টি করত।
তারপর ইন্টার্নশিপ করার সময় এমন কারো সাথেও ডিউটি পড়েছে, যার সাথে হয়ত ৪-৫ বছরে একদিন ও কথা বলিনি, আর তখন ই আবিষ্কার করা যে ছেলেটা (তখন আর “মাল” নয়) তো খুব একটা খারাপ না। এমনকি কিভাবে ডিউটি তে ফাঁকি মারা যাবে সেসব প্ল্যান ও এদের সাথেই হত। তারপর কোন “নিষ্ঠুর” পিজিটি কে গালাগালি করা বা কিভাবে ফাঁসানো যায় এসব নিয়ে যখন কোনো সেমিনার বা প্যানেল ডিসকাশন হত তখন কেউ আর আগের কথা মনে রাখত না। আশা করব সেসব নিষ্ঠুরতম পিজিটি দাদা দিদিরা ও আমাদের ক্ষমা করেছেন।
খুব সৌভাগ্যবশত নিজের কলেজেই আবার পিজি করতে ফিরে এসেছিলাম। তখন অনেক সময় ইন্টারনদের সঙ্গে খোটাখুটি লাগত (আসলে আমি যেরকম ফাঁকিবাজ, এরাও ঠিক সেরকমই জুটেছিল, তবে এখন বোধহয় এরাও আমাকে ক্ষমা করে মহানুভবতার পরিচয় রেখেছে), বেশির ভাগ সময় আবার খুব ভাল সময় ও কেটেছে এদের সঙ্গে। এদের অনেকে আবার বিরুদ্ধ পার্টির প্রাক্তন নেতাও ছিল। কিন্তু তখন ও সিনিয়র জুনিওর সম্পর্কটাকে অন্য কোন পরিচয় ছাপিয়ে যেতে পারেনি। তাদের থেকে জানতে পেরেছি, এরা আগে আমাকে কি কি ডাকনাম দিয়েছে, কিভাবে এরা আমাকে নকল করত, আমার কাজকর্ম মিমিক্ৰি করত ইত্যাদি (তার প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক ফন্দিফিকির করেও ব্যর্থ হয়েছি)। আবার কখনও কোন জুনিয়র ডাক্তার মার খেলে এদের সবাইকে দেখেছি পার্টি নির্বিশেষে ছুটে আসতে।
তারপরেও অনেক দিন কেটে গেছে। “তুই কোন কলেজের” এর উত্তরে যখন কেউ শোনে “মেডিক্যাল কলেজ”, তখন পারলে অনলাইনেও একজন আর একজনের সাথে কোলাকুলি করে নেয়। তখন কেউ জানতে চায়না “তুই কি করতিসইয়রসিপি, ডিএসএ না এসএফআই।
একটা “ছোট্ট” উদাহরণ দেব। ডিএসএর’র একটা “নেতা গোছের” দাদা আমাকে হস্টেলে বেড নেওয়া নিয়ে এক ঘন্টা লেকচার এর পরে প্রায় অনেকে হোস্টেল এ নিয়ে যাচ্ছিল। আমি যাবনা বলি। পরে সেই দাদা যতদিন কলেজে ছিল আর কথাই বলিনি। (এটা বোধহয় মেডিক্যাল কলেজেই সম্ভব)। প্রায় ১৫ বছর পরে আমার মা যখন হাসপাতালে ভর্তি, দরকারে পড়ে (দরকার না হলে কেউ কারো খবর নেয় না), সেই দাদার সাথে যোগাযোগ করলাম। নিজের ই কেমন যেন একটা মনে হচ্ছিল, আর একটা অপরাধবোধ মিশ্রিত হাসি পাচ্ছিল। সেদিন তার কথা গুলো ছিল এরকম “আর এ তোকে তো মনে আছে। বলে কেমন আছিস……. কোন চিন্তা করবিনা, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, অসুবিধা হলে আবার জানাবি”।
এখনো যেটুকু করে খাচ্ছি, সেটার বেশির ভাগটাই এই অস্টাশি নম্বর কলেজ স্ট্রিটের সিনিয়র জুনিয়রদের থেকে শেখা। এখনো গর্বের সাথে গিনিস বুকে (যদি আমার সেই ক্ষমতা থাকত) লিখে দিতে পারি, “মেডিক্যাল কলেজের অভিধানে র্যাগিং বলে কোন শব্দ ছিলনা, নেই আর কোনদিন থাকবে ও না”।
লেখকঃ
গাইনোকলোজিস্ট ও ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ
কোলকাতা