হৃদয় বা মন, এর সঙ্গে হৃদ্যন্ত্রের সত্যিকারের যোগাযোগ কতটুকু, তা নিয়ে যতই বিতর্ক আর গবেষণা চলুক, এ কথা আজ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে মনের সমস্যার সঙ্গে হৃদরোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিত্বের ধরন, মনের অসুখ, চাপ, উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা ইত্যাদি মানসিক অবস্থা হৃদরোগের অন্যতম কারণ বলে আবিষ্কৃত হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু গবেষণা হচ্ছে, মনের সমস্যার সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক এখন প্রমাণিত সত্য, কিন্তু বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এইচ এফ ডাম্বার তাঁর ইমোশন অ্যান্ড বডিলি চেঞ্জ গ্রন্থে এ বিষয়ে গবেষণাপ্রসূত তথ্য দেন।
তিনি বলেন, আবেগের নানা রকম সমস্যা, মানসিক চাপ ও ব্যক্তিত্বের ধরন হৃদরোগের অন্যতম একটি কারণ। তিনি সর্বপ্রথম ‘করোনারি পারসোনালিটি’ নামে ব্যক্তিত্বের প্রকরণ ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, এ ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের আচরণকে পরে ১৯৬০ সালে ফ্রাইডম্যান ও রোসেনম্যান ‘টাইপ-এ আচরণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
পরবর্তী আরও গবেষণায় ১৯৭৫ সালে ফ্রাইডম্যান ও তাঁর সহযোগীরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেন, যাদের মধ্যে টাইপ-এ আচরণ দেখা যায় বা যারা করোনারি পারসোনালিটির অধিকারী, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি! কেমন আচরণ হয় করোনারি পারসোনালিটির মানুষের, আর টাইপ-এ আচরণই বা কী?
গবেষণায় এ ধরনের ব্যক্তিত্বের যে বৈশিষ্ট্য ও আচরণগুলো বের হয়ে এসেছে, তা হলোঃ
ক্রমাগত আবেগের সমস্যায় থাকা, সামান্য মনখারাপের বিষয়ে বেশি ভেঙে পড়া বা কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অত্যধিক আবেগ প্রকাশ করা। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আশপাশের মানুষের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিত থাকা। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও কর্মপরিধির মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মানসিক চাপ বোধ করা। কোনো কারণ ছাড়াই পারিপার্শ্বিকতার প্রতি বৈরী ভাব পোষণ করা (যেমন-এ দেশের সবাই খারাপ, সব মানুষ লোভী, কেউ ভালো নয়, সবাই আমার শত্রু ইত্যাদি মনে করা)।
সব সময় একটা প্রতিযোগিতামূলক আচরণ করা, বেশি পরিমাণে উচ্চাভিলাষী হওয়া (যেমন-অমুকের চেয়ে আমার এ বিষয়ে ভালো করতেই হবে, ওর আগে আমার প্রমোশন হতেই হবে, আমার সন্তানকে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেতেই হবে ইত্যাদি মনোভাব)। কারণে-অকারণে সব কাজে তাড়াহুড়ো করা। সব সময় একটা পূর্বনির্ধারিত ‘ডেডলাইন’ মাথায় রাখা যে এ সময়ের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি হতে হবে, সময়মতো না হলে তীব্র মানসিক চাপে ভোগা। হুট করে রেগে যাওয়া, অধৈর্য হওয়া, খিটখিটে আচরণ করা। এ ধরনের আচরণ আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা আক্রান্ত হতে পারে হৃদ্যন্ত্রের যেকোনো রোগে, বিশেষত রক্ত সরবরাহ-সংক্রান্ত জটিলতায় (ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ), যার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে বুকে ব্যথা আর পরিণতিতে মৃত্যু।
এ তো গেল আচরণ আর ব্যক্তিত্বের কথা। এদিকে কিছু মানসিক রোগের সঙ্গেও সরাসরি হৃদরোগের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।
যেমন উৎকণ্ঠা (অ্যাংজাইটি) আর অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে হতে পারে এনজিনা বা ব্যথাযুক্ত হৃদরোগ। তীব্র বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠার যদি চিকিৎসা করা না হয়, তবে এ দুটি রোগ থেকে হতে পারে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’ নামের মারাত্মক হৃদরোগ, যাতে মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানা রকম মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত দু-একটি ওষুধ হৃদ্যন্ত্রের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত কোনো কোনো ওষুধ বিষণ্নতাসহ আরও কিছু মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি আরেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যাদের সফলভাবে করোনারি বাইপাস সার্জারি বা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ পরবর্তী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতা ও মানিয়ে চলার সমস্যায় (অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার) আক্রান্ত হতে পারে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয় ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এসব রোগীকে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি নিয়মিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হচ্ছে। হৃদরোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় কেবল খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ব্যায়াম আর ওষুধ সেবনই যথেষ্ট নয়; জীবনযাত্রার পরিবর্তন, আচরণের পরিবর্তন এবং সঠিক মানসিক সাম্যাবস্থাও প্রতিরোধ করতে পারে জীবনবিনাশী হৃদরোগ। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে সবাইকে।