ক্যান্সারসহ জটিল রোগ নির্ণয়ের জন্য আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনছে সরকার। ফলে পিইটি-সিটি পরীৰা ও অন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশের রোগীদের আর বিদেশে যেতে হবে না। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এছাড়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহায়তায় পোস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে চিকিৎসক, পদার্থবিদ ও রসায়নবিদদের উচ্চতর গবেষণা ও নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ। আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এটি অনুমোদন দেয়া হতে পারে। অনুমোদন পেলে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে ১৪টি পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বল্পমূল্যে সেবা প্রদান করা হয়। এছাড়া প্রশিৰণ ও কর্মশালার মাধ্যমে এসব কেন্দ্র হতে পরমাণু চিকিৎসা প্রযুক্তির বিষয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটোমিক এ্যানার্জি এজেন্সি (আইএইএ)-এর টেকনিক্যাল কো-অপারেশন এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রচেষ্টায় দেশে এখন নিউক্লিয়ার মেডিসিনের উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি এবং কম্পিউটেড টমোগ্রাফি অর্থাৎ একত্রে পিইটি-সিটি একটি নতুন প্রযুক্তি, যা মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যকারিতার সমন্বিত নিখুঁত ইমেজ (প্রতিচ্ছবি) প্রদানে সৰম। বস্তুত পিইটি নিউক্লিয়ার মেডিসিনে অতি উলেস্নখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে চিকিৎসাৰেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। গতানুগতিক ইমেজিং প্রযুক্তি থেকে পিইটির পার্থক্য হলো, এখানে জীবনের মৌলিক উপাদান যেমন-অঙ্েিজন, কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদির ৰণস্থায়ী (২-১১০ মিনিট) পজিট্রন বিকিরণকারী রেডিও আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। রেডিও-আইসোটোপগুলো সাইক্লোট্রোনের সাহায্যে প্রস্তুত করা হয় এবং বিশেষায়িত রেডিও কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে এগুলোকে ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে যুক্ত করে তা রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় রোগীর দেহে প্রদান করা হয়।
পিইটি প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রেডিও- ফার্মাসিউটিক্যালস হলো ফ্লোরিন-১৮-ফ্লুরোডিঅঙ্গিস্নুকোজ। ইনজেকশনের পরে এই রেডিও ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো ক্যান্সার কোষ অধিকমাত্রায় গ্রহণ করে এবং অতিসংবেদনশীল পিইটি স্ক্যানার কোষ থেকে মেটাবলিক সিগন্যাল সংগ্রহ করে। সিটি স্ক্যান মানবদেহের অভ্যনত্মরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইমেজ নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারলেও মানবদেহের কোন টিউমার বা বড় ধরনের ক্যান্সার আছে কিনা তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে না। এ কারণে পিইটি-সিটি প্রযুক্তির উন্নয়ন এমনভাবে করা হয়েছে যে পিইটি এবং সিটির ইমেজগুলো একীভূত করা যায়, যা পৃথকভাবে পিটি ও সিটি ইমেজ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং তথ্যসমৃদ্ধ। এর মাধ্যমে পিটি ইমেজের ফাংশনাল ডাটা এবং সিটি ইমেজের এ্যানাটমিক্যাল ডাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়, যাতে একটি বিসত্মারিত এবং তথ্যসমৃদ্ধ ইমেজ দিতে পারে।
সুতরাং পিইটি- সিটি প্রযুক্তি মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষের গাঠনিক এবং বিপাকীয় তথ্য মূল্যায়নের একটি নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি এবং এটি প্রচলিত অন্যান্য ডায়াগনস্টিক থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক। সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারের অবস্থান ও বিসত্মার পিইটি-সিটি প্রযুক্তি দ্বারা নির্ণয় করা গেলে রোগীদের কার্যকর ও ফলপ্রসূ চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। রোগীর যথাযথ চিকিৎসার সঠিক নির্দেশনা প্রদান করা যাবে। রোগী অপারেশনের অযোগ্য হলে থেরাপিউটিক অপসন কি হবে পিইটি-সিটি প্রযুক্তি সে বিষয়েও নির্দেশনা দিতে পারবে।
পিইটি-সিটি প্রযুক্তি কেমোথেরাপির ৰেত্রে ড্রাগ রেজিস্টার ক্যান্সার গ্রোথ সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে উপযুক্ত কেমোথেরাপি প্রদানে সাহায্য করবে। ক্যান্সার ছাড়াও পিইটি-সিটি প্রযুক্তি কার্ডিয়াক রোগ নির্ণয়ের ৰেত্রেও একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং পাকিসত্মান ইতোমধ্যে এ প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন জটিল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান করছে। এমনকি শুধু পিইটি-সিটি পরীৰার জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী এ সমসত্ম দেশে যাচ্ছে। এ দেশে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার অভাবে প্রায় ৪০ ভাগ ক্যান্সার রোগী দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এ প্রেৰিতে দেশে পিইটি-সিটি প্রযুক্তি স্থাপন করা হলে দেশেই ক্যান্সারসহ জটিল রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রম হচ্ছে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত নির্মাণ ও অন্য সুযোগসুবিধাসমৃদ্ধ ক্যান্সারসহ জটিল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদানের লৰ্যে একটি পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি কম্পাউন্ড টমোগ্রাফি কেন্দ্র এবং একটি সাইলোট্রন সেন্টার স্থাপন করা হবে। এটি চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প হিসেবে বরাদ্দহীনভাবে সবুজ পাতায় অন্তর্ভুক্ত আছে। এ প্রকল্পটির বিষয়ে প্রস্তাব পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশনে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিকল্পনা কমিশনের পৰ থেকে দেয়া সুপারিশে বলা হয়েছে প্রকল্পের অনুকূলে এমটিবিএফ বরাদ্দসংক্রানত্ম তথ্যাদি এবং এ সম্পর্কিত সচিবের প্রত্যয়নপত্র ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।
আলোচ্য প্রকল্পের অনুকূলে চলতি অর্থবছরে চাহিদাকৃত ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এডিপিতে বিজ্ঞান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নতুন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত থোক বরাদ্দ দেয়া যাবে। এ প্রেৰিতে এবং জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বছরভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ প্রসত্মাব করা হয়েছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫০ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।