বর্তমান বিশ্বের বহুলপরিচিত একটি নাম এইডস (AIDS)৷ এটি একটি মরণব্যধি ৷ এইডস এর পুরো অর্থ একোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম৷ এইডস এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগ৷ উন্নত অনুন্নত সকল দেশেই এইচআইভি আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশু৷ বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়েসী মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়৷ এইডস প্রথম শনাক্ত করা হয় আমেরিকাতে ১ঌ৮১ সালে৷ তবে প্রথম দেখা যায় ১ঌ৭০ সালের শেষদিকে আফ্রিকার বিষুবীয় অঞ্চলে এবং ১ঌ৭৮ সালে যুক্তরাজ্যে৷ এইচআইভি ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকাগুলোকে নষ্ট করে দেয়৷ ফলে এইচআইভি আক্রমণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়৷ যার ফলে যেকোনো ধরনের রোগে শরীর খুব তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে৷
ইউএনএইড-এর ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ৪০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত৷ আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই জানে না তারা এই ভাইরাস বহন করছে এবং এটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে যেতে পারে৷ এই মহামারীর শুরুতেই বিশ্বে ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে৷ এর মধ্যে আমেরিকান ছিল ৫ লাখেরও বেশি ৷ শুধু ২০০৫ সালেই মৃত্যুবরণ করেছে ৩.১ মিলিয়ন মানুষ৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারী ও নেশাগ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণ যথেষ্ট বেড়েছে৷ ১৯৯৭ সালে এইচআইভি সংক্রমিতদের ৪১ শতাংশ ছিল নারী, ২০০৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০শতাংশ৷ এশিয়া অঞ্চলে ২০০৫ সালের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ৮.৩ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছে যার মধ্যে ২ মিলিয়ন হলো নারী৷ ২০০৫ সালে প্রায় ০.৪ মিলিয়ন মানুষ এ অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রায় দ্বিগুণ ১.১ মিলিয়ন নতুন করে এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে৷ এশিয়া অঞ্চলে ভারত ও চীনে এইচআইভি সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করেছে৷ সারা পৃথিবীতে ১৩ মিলিয়নেরও অধিক শিশু এইডস-এর কারণে এতিম হয়েছে৷
সরকারী তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে একজন পুরুষের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া যায়৷ ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ জনে৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷ তারপর থেকে প্রতি বছরই এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ গত বছর নতুন ১১৫ জনসহ এ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা মোট ৪৬৫ জন৷ এর মধ্যে এইডস হয়েছে ৮৭ জনের এবং মারা গেছেন ৪৪ জন৷ অন্যদিকে, এইডস সম্পর্কিত যৌথ জাতিসংঘ কর্মসূচি (ইউএনএইডস)-এর …রিপোর্ট অন দি গ্লোবাল এইচআইভি/এইডস এপিডেমিক ২০০২– প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার৷ সরকারের সেপ্টেম্বর ২০০৫-এর ষষ্ঠ পর্যায়ের জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নীচে৷ তবে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার আগের তুলনায় বেড়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের হার যদি শতকরা ৫ ভাগ ছাড়িয়ে যায় তাহলে তাকে মহামরী বলতে হবে৷ এই হিসাব অনুসারে দেশে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহীতাদের মধ্যে এ হার মহামারী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ জরিপ অনুযায়ী ৭০ ভাগের বেশি মাদক গ্রহণকারী নিজেদের মধ্যে সিরিঞ্জ বিনিময় করে৷ ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহীতারা এইচআইভি/এইডস বিস্তারের ক্ষেত্রে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে |
- শরীরের ওজন কমে যাওয়া
- ক্লান্তি বোধ করা
- দীর্ঘদিন ধরে জ্বর থাকা
- মুখে বা গলায় ঘা
- বমিবমি ভাব বা বমি
- এক মাসের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া
- মাথা, চোখ এবং মাংসপেশিতে ব্যথা
- গা ম্যাজ ম্যাজ করা
- চর্মের ওপর নানা ধরনের ফুসকুড়িঁ
- নাক-কান-গলার সমস্যা
- ঠোঁট ও যৌন অঙ্গের চারপাশে ধীরে ধীরে ফোসকা ও ঘা ছড়িয়ে পড়ে
- রক্ত (Blood)
- সিমেন (Semen)
- সারভাইকো ভেজাইনাল সিক্রেশন (Secretion)
- লালা (Saliva)
- বুকের দুধ
- সি.এস.এফ (CSF)
এইডস যেভাবে ছড়াতে পারে
- এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কনডম ছাড়া যৌনমিলন করলে
- এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত অন্য কোনো ব্যক্তি গ্রহণ করলে
- এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যেমন- সুঁচ, চাকু, কাঁচি, ব্লেড, ক্ষুর, সিরিঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহার করলে
- একই সরিঞ্জ দিয়ে শিরার মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করলে
- এইডস আক্রান্ত নারী গর্ভধারণ করলে গর্ভের সন্তানেরও এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
- এইডস আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ পানের মাধ্যমে শিশু এইডস আক্রান্ত হতে পারে
- হাতে হাত মিলালে বা কোলাকুলি করলে
- এক সঙ্গে বসবাস, খাওয়া দাওয়া বা খেলাধুলা করলে
- একই পাত্রে খাদ্য গ্রহণ করলে
- একত্রে গোসল করলে বা একই পুকুরে গোসল করলে
- হাঁচি, কাশি ও থুথুর মাধ্যমে
- বিড়াল, কুকুর, বা গৃহপালিত পশু-পাখি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে
- রোগীর সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমালে বা রোগীর জামা-কাপড়, তোয়ালে-গামছা, থালা-বাসন, গ্লাস ব্যবহার করলে
- একই পায়খানা ব্যবহার করলে
- রোগীদের স্পর্শ করলে
- খাদ্য, পানীয়, মশা, মাছি, উকুন, আরশোলা, তেলাপোকা বা অন্য কোনো কীটপতঙ্গের মাধ্যমে এইডস ছাড়ায় না
ব্যক্তিগত পদক্ষেপ
- স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও নারী বা পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলন অনুচিত
- যৌনমিলনে প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করা উচিত
- অপরের দাড়ি কামানোর ব্লেড, ক্ষুর ব্যবহার করা উচিত নয়
- একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলন করা ঠিক নয়
- মাদকদ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
- এইডস আক্রান্ত মহিলাদের গর্ভধারণ করা উচিত নয়
- রক্ত গ্রহণ করার পূর্বে এইচআইভি পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত
- সুঁচ ও সিরিঞ্জ একবার ব্যবহার করা উচিত
- অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সতকর্তা অবলম্বন করা উচিত
- বিয়ের আগে দৈহিক মেলামেশা করা উচিত নয়
সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা দেখতে পাওয়া যায় না৷ অথচ এইডস প্রতিরোধ করতে হলে জনসাধারণের মধ্যে এই বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন৷ এ সম্পর্কে সচেতন করতে সম্মিলিতভাবে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত –
- মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিস্তরের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে এইডস-এর সচেতনতা সম্পর্কে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা৷ স্কুলের শিক্ষকদের উচিত এইডস সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের গল্প বা কার্টুন দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করা, যেন ব্যাপারটা তাদের কাছে সহজবোধ্য হয়৷
- পেশাদার রক্ত দাতাদের রক্ত প্রদানে বাধা প্রদান করতে হবে৷ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রক্ত বেচাকেনা বন্ধ করতে হবে৷
- একজন সুস্থ মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উত্সাহিত করতে হবে৷
- রেডিও, টেলিভিশন, নাটক, পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বিনোদনের মাধ্যমে জনগণকে এইডস-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে৷
- পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে এইডস সম্পর্কিত তথ্য মানুষকে জানাতে পারে৷
-
-
এইডস পরীক্ষারক্তের এইচআইভি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা এইডস হয়েছে কিনা জানতে পারি৷ বিনামূল্যে রক্তের এইচআইভি পরীক্ষা করানো হয় এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হলো-১. ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ (আইপিএইচ), মহাখালী, ঢাকা ৷
২. ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (সাবেক পিজি
হাসপাতাল) ঢাকা
৩. আর্মড ফোর্সেস ইনিস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, ঢাকা৷
৪. এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ , সিলেট .
৫. চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম ৷
৬. খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা ৷
৭. ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্ট, ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলোজিক্যাল ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ, মহাখালী, ঢাকা৷
-
এইডস আক্রান্ত রোগীদের প্রতি আমাদের কর্তব্যসমাজের প্রত্যেক মানুষের উচিত এইডস আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে সহানভূতিপূর্ণ আচরণ করা৷ এইডস আক্রান্ত রোগীকে অবহেলা না করে তার প্রতি স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা প্রদান করা, যেন মানসিকভাবে সে একটু শান্তি পায়৷ কোনো যৌনকর্মীর এইডস ধরা পড়লে তাকে অন্য কোনো কর্মসংস্থনের ব্যবস্থা করে দেওয়া৷ এইডস আক্রান্ত স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া৷ রোগীর যে কোনো প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসা৷ রোগীর জন্য সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করা৷
এখন পর্যন্ত এইডস রোগের পুরোপুরি চিকত্ সা আবিষ্কৃত হয়নি৷ তবে কিছু কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে একজন এইডস রোগী অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারেন৷ যেমন-
- পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত৷
- নিজেকে কর্মক্ষম রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা ও ঘুমানো উচিত৷
- সম্ভব হলে চাকরি চালিয়ে যেতে হবে
- চিকিত্সকের নিকট কোনও কথা গোপন না করে সবকিছু খুলে বলা উচিত
- মদ ও ধূমপান এড়িয়ে চলা
- নিজেকে গুটিয়ে না রেখে সবার সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত৷
- রোগীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে৷
এইডস পরিচিতি ও প্রতিরোধ, হাফিজউদ্দীন আহমদ,
যৌন রোগের নানা কথা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
এইচআইভি ও এইডস বিষয়ক ইউএনএইডস-এর পরিসংখ্যান রিপোর্ট, নভেম্বর ২০০৫৷
ইন্টারনেট (www.avert.org)৷
দৈনিক পত্রিকা